বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম।
الحمد لله، الحمد لله omega_{1} العالمين শোকর আদায় করছি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের, যিনি আজকে এই পবিত্রতম বিষয়ে বার্ষিকীতে লেখার সুযোগ দিলেন। কৃতজ্ঞতা মহান আল্লাহর, কুরআনের মতো সুস্পষ্ট গাইড লাইন দিয়ে যিনি আমাদের পাঠিয়েছেন। দরুদ ও সালাম প্রিয় নবীর জন্য, যিনি ছিলেন জীবন্ত কুরআন।
আমি এই কুরআনের অবতরণ প্রক্রিয়ার এমন সব বিষয় অবর্তীর্ণ করছি যা মুমিনদের জন্য নিরাময় ও রহমত এবং জালেমদের জন্য ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করে না। (সূরা বনি ইসরাঈল)
পবিত্র কুরআন একটি আদর্শ সমাজ বিনির্মানের জন্য সমাজের প্রতিনিধি মনের ক্ষতকে নিরাময় করে সুস্থ ও নীতি নৈতিকতা সম্পন্ন এক জাতি গঠনের নির্দেশনা দেয়। ন্যায় ও ইনসাফপূর্ণ সামাজিক অনুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজ কিভাবে আলোকিত হতে পারে, তার বাস্তব নমুনা দেখিয়েছেন মানব মুক্তির প্রেসক্রিপশন পবিত্র কুরআন। পৃথিবীর ইতিহাসে দীর্ঘ কয়েক দশক মানবতা বুক ভরে শ্বাস নিতে পেরেছে, শিশুরা নির্মল হাসি দিতে পেরেছে, অবলা অসহায় নারী তার সম্ভ্রম ফিরে পেয়েছে শুধুমাত্র কুরআনের বিধানসমূহ মেনে চলার কারণে। আর এমন এক শান্তিপূর্ণ আদর্শ সমাজের কারিগর ছিলেন রাসূল কারীম হযরত মুহাম্মদ (স.)।
একটি আদর্শ সমাজ বিনির্মানে পবিত্র কুরআন এমন কিছু মানবীয় গুণাবলী অর্জনে গুরুত্ব দিয়েছে যার মাধ্যমে সমাজের প্রতিটি শ্রেণী পেশার মাঝে ভারসাম্য সাধন হয়। সমাজে মানব কল্যাণ সুনিশ্চিত হয়।
■ আল কুরআন সামাজিক কল্যাণ উজ্জীবিত হওয়ার শক্তি: কুরআন মহান রবের নিরংকুশ আনুগত্য করার মাধ্যমে মানবতাকে রুবুবিয়াত প্রতিষ্ঠা করতে শিখাচ্ছে। এই বিষয়ে কুরআনে বর্ণিত উজ্জীবিত হওয়ার শক্তিসমূহ আলোচনা করা হলো:
। ভ্রাতৃত্বের বন্ধন: পবিত্র কুরআনে ঘোষণা হয়েছে, মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। অতএব তোমাদের ভাইদের মধ্যকার সম্পর্ক ঠিক করে দাও। আল্লাহকে ভয় কর, আশা করা যায় তোমাদের প্রতি মেহেরবানী করা হবে। (সূরা হুজরাতঃ ১০)। এ আয়াত সমস্ত ঈমানদার সমাজকে ভ্রাতৃত্বের নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ করতে শেখায়।
■ শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি: বর্ণ, বংশ, ভাষা, গোত্র কিংবা বিভিন্ন অঞ্চলকে ছাড়িয়ে যেয়ে কুরআন শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হিসেবে গণ্য করেছে তাক্বওয়াকে।
কুরআনের ভাষায়: হে মানবজাতি! আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ এবং একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। তারপর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে দিয়েছি যাতে তোমরা পরস্পর চিনতে পার। তোমাদের মধ্যে যে অধিক পরহেজগার সেই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদার অধিকারী। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহা জ্ঞানী ও সবকিছু সম্পর্কে অবহিত। (সূরা হুজরাত: ১৩)
বস্তুত এই আয়াত নাযিলের মাধ্যমে সমাজের মানুষের মধে বর্ণ, গোত্র, বংশ, ভাষা, সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব বা অহংকার করার প্রবণতা নির্মূল করে দেওয়া হল। সব মানবতাকে তাক্বওয়া, ঈমান ও নেক কাজের ভিত্তিতে বিচার করতে বলা হয়েছে।
■ ঐক্যের শক্তিতে আবদ্ধ করা:
সমাজের প্রতিটি বাসিন্দা যাতে হিংসা ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ঐক্যের শক্তিতে আবদ্ধ হতে পারে কুরআন এই ব্যাপারে জোর তাগিদ দিয়েছে। কুরআনের ঘোষণা, তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রুজু মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরো এবং দলাদলি করো না। (সূরা আলে ইমরান: ১০৩)
■ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন:
একজন একনিষ্ঠ মুসলিম শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই সমাজে দুঃস্থ অসহায়, ইয়াতীম, বিধবা ও দূর্বল মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত হবেন, দুনিয়াবী সম্মান ও বাহবা পাওয়ার জন্য নয়। কুরআন এ ব্যাপারে বলে, বলো আমার নামায, আমার ইবাদতের সমস্ত অনুষ্ঠান, আমার জীবন ও মৃত্যু
সবকিছু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য। (সূরা আল আনআম: ১৬২)
■ মানব জীবনের মূল লক্ষই হচ্ছে মানবতার কল্যাণ: সমগ্র উম্মাহ বা জাতির উপর মহান রাব্বুল আলামীন মুসলিম
উম্মাহকে অনেক মর্যাদা দিয়েছেন। এর কারণ হিসেবে কুরআন বলেছে: এখন তোমরাই দুনিয়ায় সর্বোত্তম দল, তোমাদের কর্ম ক্ষেত্রে আনা হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য, তোমরা নেকীর হুকুম দাও, দুষ্কৃতি থেকে বিরত রাখো এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনো। (সূরা আলে ইমরান: ১১০)।
এই আয়াতে মুসলিম মিল্লাতকে মানবতার কল্যাণে এগিয়ে আসার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়েছে। এভাবে কুরআন এ আয়াতের মাধ্যমে সমাজের সব নাগরিককে একে অপরের সাহায্য এগিয়ে আসার, সুখে দুঃখে পরস্পরের অংশীদার হতে উৎসাহ জুগিয়েছে।
■ আদর্শ সমাজ বিনির্মানে আল কুরআন, সমাজে ন্যায় ও সমাজ সংস্কার ও সুশাসনের লক্ষ্যে (কুরআনের সূরা হাদিদের
ইনসাফ প্রতিষ্ঠা:
২৫ নং আয়াতে) আমি আমার রাসূলগণকে স্পষ্ট প্রমাণাদিসহ পাঠিয়েছি এবং তাদের সাথে কিতাব ও মিজান নাযিল করেছি যেন মানুষ ইনসাফের উপর কায়েম থাকতে পারে। ইসলামে দাওয়াতের একমাত্র উদ্দেশ্য মানব জীবন ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তিতে গড়ে তোলা এবং সমাজ ব্যবস্থায় কার্যকরভাবে ভারসাম্য নীতি প্রতিষ্ঠা করা। ফলে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ নিশ্চিত হবে। দুনিয়ার কল্যাণ ও আখিরাতের কল্যাণ এই সহজ সরল শব্দ দুটিকে কোন আংশিক কল্যানের অর্থে গ্রহণ করা একেবারেই অযৌক্তিক। আসলে দুনিয়ার কল্যাণ বলতে অর্থনীতির সর্বাঙ্গীন সুন্দর হওয়া, সমাজ ব্যবস্থা নিশ্চিত হওয়া এবং পবিত্র জীবনে অধিকারী হওয়া। আর এই সকল দিক নিয়েই পবিত্র কুরআনে অত্যন্ত চমৎকারভাবে আলোচনায় এসেছে। মানব জীবনের বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় বা জীবন ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে মূলনীতি প্রদান করে কুরআন মানব কল্যাণে কী ভূমিকা রাখছে এবার সেই প্রসঙ্গে আসা যাক।
পরিবার ব্যবস্থাপনা:
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُوْنَ بِهِ
وَالْأَرْحَامِ. হে মানব জাতি! তোমাদের রবকে ভয় করো। তিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন একটি প্রাণ থেকে। আর সেই একই প্রাণ থেকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ নারী এবং আল্লাহকে ভয় করো যার নামের দোহাই দিয়ে তোমরা একে অপরকে যাঞ্চা কর এবং আত্মীয়দের ব্যাপারে সতর্কতা
অবলম্বন কর। (সূরা নিসা: ১) এই আয়াতটি আদর্শ সমাজ গড়ে তোলার জন্য মাইলফলক।
আল্লাহ সর্বপ্রথম একজোড়া মানুষ (আদম আঃ ও হাওর সৃষ্টি করেছেন তারপর সে জোড়া হতে দুনিয়ার সকল মানুষের। জন্ম হয়েছে। একটি পবিত্র নিষ্কলুষ সৌহার্দপূর্ণ সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কুরআন ঘোষণা করেছে। আল্লাহ ন্যায়নীতি পরোপকার আত্মীয় স্বজনকে দান করার হুকুম দেন এবং অশ্লীল, নির্লজ্জতা, দুষ্কৃতি, অত্যাচার ও বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেন তিনি তোমাদের উপদেশ দেন, যাতে তোমরা শিক্ষা লাভ করতে পার। (সূরা নাহল: ৯০) ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার
বুনিয়াদ: মানব সমাজের প্রাথমিক ও বুনিয়াদি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে পরিবার। একটি আদর্শ পরিবার গড়ে তোলার জন্য কুরআন উপমা দিয়েছে ৪টি পরিবারের। আল্লাহ বিশ্ববাসীর মধ্যে বাছাই করেছেন আদম, নূহ্ ইব্রাহি-ে মর বংশধর এবং ইমরানের বংশধরকে এবং তারা পরস্পরের বংশধর। আল্লাহ সব শোনেন, সব দেখেন। (সূরা আলে ইমরান: ৩৩-৩৪) –
আদর্শ পরিবারের উজ্জীবিত শক্তি হচ্ছে মানসিক প্রশান্তি। তাই পৃথিবীর আদি পরিবার গড়ার ক্ষেত্রে কুরআন বলে “আমরা আদমকে বললাম তুমি ও তোমার স্ত্রী উভয়ে জান্নাতে অবস্থান কর শান্তিপূর্ণভাবে। (সূরা বাকারাহ: ৩৪)
অন্যত্র বলা হয়েছে “আল্লাহ তোমাদের জন্য তোমাদের ঘরগুলোকে বানিয়েছেন শান্তির আবাস” (সূরা নাহল: ৮০) এই আয়াতগুলো থেকে বুঝা যায় একটি শান্তিপূর্ণ পরিবার গঠনের জন্য দরকার হচ্ছে নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা, উভয়ের সম্মিলনে গড়ে ওঠে সমাজের ক্ষুদ্র ও গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট যার নাম পরিবার। উজ্জ্বল ভবিষ্যত বিনির্মানে কুরআন অনাগত প্রজন্মকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। ফুরকানে ৭৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে, তারা দোয়া করে এভাবে আমাদের রব আমাদের স্বামী/স্ত্রী ও সন্তানদের চক্ষুশী- তলকারী বানাও আমাদের বানাও মুত্তাকীদের নেতা।