ইয়াতীম ( শব্দটি আরবি। অর্থ-অভিভাবকহীন অনাথ/নি:সঙ্গ/একাকী/পিতৃহীন ইত্যাদি। Helpless, on orphan, guardianless,
পরিভাষায়- الْيَتِيمُ مَنْ مَاتَ أَبُوهُ وَهُوَ صَغِيرٌ يَسْتَوِي فِيهِ الْمُذَكَّرُ وَالْمُؤَنَتُ অর্থাৎ, ছেলে হোক বা মেয়ে হোক, শৈশবে যার পিতা মৃত্যুবরণ করেছে তাকে ইয়াতীম বলা হয়। শৈশবে কেবল মাতা মৃত্যুবরণ করলে তাকে ইয়াতীম বলা হয় না, তবে শৈশবে যার পিতা-মাতা দু’জনই মৃত্যুবরণ করে সে হয় সমাজের সবচেয়ে বড় অসহায়। একজন শিশু বালেগ হওয়া পর্যন্ত ইয়াতীম বলে পরিগণিত হবে। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, لَا يُتْمَ بَعْدَ إِحْتِلَامٍ অর্থাৎ যৌবনপ্রাপ্ত হলে আর ইয়াতীম থাকে না। শিশু মেয়ে হলে বিয়ের পূর্ব পর্যন্ত ইয়াতীম হিসেবে গণ্য হবে।
ইয়াতীম প্রতিপালনের গুরুত্ব অপরিসীম। পবিত্র কুরআন মাজীদের যেখানেই সদয়, সহানুভূতি ও ভালো আচরণের কথা বলা হয়েছে সেখানেই ইয়াতীমদের ব্যাপারে কথা এসেছে। এ বিষয়ে- মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,
واعْبُدُوا اللهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنَّبُ وَابْنِالسبيل
অর্থাৎ, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তার সাথে কোনো কিছুকে শরীক কর না। পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, অভাবগ্রন্থ, নিকট প্রতিবেশী, দূরপ্রতিবেশী, ংগী-সাথী ও মুসাফিরের প্রতি সদাচরণ কর। (সূরা সা-আয়াত: ৩৬)
-সম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্রেও ইয়াতীমদের গুরুত্ব দেয়া য়েছে।
এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন- يَسْتَلُوْنَكَ مَاذَا يُنْفِقُوْنَ – قُلْ مَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ خـ قَلِلْوَالِدَيْنِ وَالأَقْرَبِينَ وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ
অর্থাৎ, (হে রাসুল!) সা. তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে যে, তারা কিরূপে ব্যয় করবে? তুমি বল, তোমরা ধন-সম্পদ হাতে যা ব্যয় করবে তা পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন ও পথিকদের জন্য কর। (বাকারা: ২১৫)। বলাবাহুল্য যে, সমাজের সর্বাধিক অসহায় হচ্ছে ইয়াতীমরা।
তারা পিতার আদর-স্নেহ থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে শিক্ষাবঞ্চিত ও শিষ্টাচার বহির্ভূত মানব শিশু হিসেবে গড়ে ওঠে। সমাজের অন্যান্য শিশুদের মত তারা বেড়ে উঠতে পারে না। অথচ ইসলাম আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বেই এর সুন্দর সমাধান দিয়েছে। সমাজের অপরাপর সদস্যদের প্রতি নির্দেশ জারি করেছে ইয়াতীমদের প্রতি সদয় ও সহানুভূতিশীল হতে। ইয়াতীমদের সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা করার মাধ্যমে আদর্শ নাগরিক ও সু-সন্তান হিসেবে গড়ে তোলা সকলেরই কর্তব্য। আল্লাহ তায়ালা জান্নাতি লোকদের
প্রশংসা করতে গিয়ে বলেন-
وَيُطْعِمُوْنَ الطَّعَامَ عَلَى حُبِّهِ مِسْكِينًا وَيَتِيمًا وَأَسِيرًا، إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللَّهِ لَا نُرِيدُ مِنْكُمْ جَزَاءً وَلَا شُكُورًا –
অর্থাৎ খাদ্যের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও তারা অভাবগ্রস্থ, ইয়াতীম ও বন্দীকে খাদ্য দান করে এবং (বলে) আমরা তোমাদেরকে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যেই খাদ্য দান করি। এর বিনিময়ে তোমাদের কাছ থেকে কোনো প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা চাইনা (দাহর: ৮-৯)
বিশ্বমানবতার অগ্রদূত বিশ্বনবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইয়াতীম লালন-পালনকারীকে জান্নাতে তার প্রতিবেশী হিসেবে ঘোষণা দিয়ে বলেন- بالسبابة والوسطى قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَافِلُ الْيَتِيمِ لَهُ أَوْ لِغَيْرِهِ أَنَا وَهُوَ كَهَاتَيْنِ فِي الْجَنَّةِ وَأَشَارَ مَالِكَ অর্থাৎ- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমি ও ইয়াতীম প্রতিপালনকারীর অবস্থান জান্নাতে এই দুই আঙ্গুলের ন্যায় পাশাপাশি হবে। চাই সে ইয়াতীম তার নিজের হোক অথবা অন্যের। ইয়াতীম প্রতিপালনে হৃদয় কোমল হয়। যাদের হৃদয় কঠোর আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে পছন্দ করেন না। হৃদয়কে কোমল করার অন্যতম মাধ্যম হলো ইয়াতীমের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া।
এ ব্যাপারে হযরত আবু হোরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত-
اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ شكا إلى رَسُولِ اللهِ صَلَّى أَنَّ رَجُلًا. قَسْوَةَ قَلْبِهِ فَقَالَ لَهُ إِنْ أَرَدْتَ تَلْبِينَ قَلْبِكَ فَأَطْعِم رأس (۲۹۳) اليتيم الـ – (رواه أحمد
অর্থাৎ- এক ব্যক্তি রাসূল (সা.) এর কাছে তার অন্তর কঠিন মর্মে অভিযোগ করলে, তিনি তাকে বললেন, যদি তুমি তোমার হৃদয় নরম করতে চাও তাহলে দারিদ্র্যকে খাবার খাওয়াও এবং ইয়াতীমের মাথা মুছে দাও। (আহমাদ ও বায়হাকী)
প্রকৃতপক্ষে ইয়াতীম প্রতিপালনে অফুরন্ত নেয়ামত লাভ ও অনেক নেকী লাভ করা যায়। অনেক সময় ইয়াতীম নিকট- াত্মীয় হলে তার ব্যাপারে মানুষ উদাসীন হয়ে পড়ে কিন্তু তাদের জেনে রাখা দরকার যে, ইয়াতীম নিকটাত্মীয় হলে দ্বিগুণ নেকী লাভ করা যায়- এ সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- إِنَّ الصَّدَقَةَ عَلَى الْمِسْكِينَ صَدَقَةً – وَهِيَ عَلَى ذِي الرَّحْمِ ثِنْتَانِ صَدَقَةٌ وَصِلَةٌ
অর্থাৎ- মিসকিনকে দান করায় একটি নেকী এবং আত্মীয় মিসকিনকে দান করায় দুটো নেকী হাছিল হয়। একটি দানের নেকী আর অপরটি আত্মীয়তার নেকী। (তিরমিযী ও নাসায়ী) ইয়াতীম ও মিসকীনদের দান করার মধ্যে যেমন ফযীলত রয়েছে তেমনি তাদের সম্পদ রক্ষার ব্যাপারেও অনেক ফযীলত রয়েছে। অন্যায়ভাবে ইয়াতীমদের সম্পদ গ্রাসক- ারীর ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে কঠিন শাস্তির কথা উল্লেখ রয়েছে। যেমন- إِنَّ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ أَمْوَالَ الْيَتَنِي ظُلْمًا إِنَّمَا يَأْكُلُوْنَ فِي بُطُونِهِمْ نَارًا وَسَيَصْلَوْنَ سَعِيرًا
ইয়াতীমদের পিছনে অর্থ ব্যয় করা কোনো সহানুভূতি নয় বরং এটা তাদের প্রাপ্য। যারা ইয়াতীমদের অধিকার সঠিক- ভাবে পালন করে না তারা এক সময় অনেক আফসোস করবে।
যেমন আল্লাহর বাণী- وَأَنْفِقُوا مِنْ مَا رَزَقْنِكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ فَيَقُوْلَ رَبِّ لَوْلَا أَخَرْتَنِي إِلَى أَجَلٍ قَرِيبٍ فَأَصْدَقَ وَأَكُمْ مِّنَ الصَّلِحِينَ
অর্থাৎ, আমি তোমাদের যা কিছু। হ অর্থ সম্পদ দিয়েছি তা থেকে তোমরা (আল্লাহর পথে) ব্যয় কর তোমাদের কারো মৃত্যু৷ আসার পূর্বেই, বলবে), হে আমার প্রভু! তুমি যদি আমাকে আরও কিছু দিনের জন্য সময় দিতে তাহলে আমি তোমার পথে ব্যয় করতাম আর তোমার নেক বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম। (সূরা মুনাফিকুন-১০)
তাই সম্পদশালী মানুষের উচিত তার জীবদ্দশায় ইয়াতিম ও অভিভাবকহীন শিশুর দায়ভার গ্রহণ করা। তাকে আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা। কেননা একটা ইয়াতীম শিশু সঠিক পরিচর্যার অভাবে নীতি নৈতিকতাহীনভাবে বেড়ে ওঠে। কিন্তু সঠিক পরিচর্যা পেলে সে একজন আদর্শ ও খোদাভীরু মানুষে পরিণত হতে পারে। সে কারণে বিত্তবানদের উচিৎ হলো তাদের সম্পদের একটি অংশ ইয়াতীম ও মিসকীনদের জন্য ব্যয় করা। কোনো অবস্থাতেই ইয়াতীমদের ধমক দেয়া যাবে না। এ বিষয়ে
পবিত্র কুরআনের সুরা দুহায় ঘোষণা করা হয়েছে- فَأَمَّا الْيَتِيمَ فَلَا تَقْهَرْ – وَأَمَّا السَّائِلَ فَلَا تَنْهَرْ অর্থাৎ- সুতরাং তুমি ইয়াতীমদের প্রতি কঠোর হয়ো না। আর সওয়ালকারীকে ভৎর্সনা কর না (দুহা-৯: ১০)
এখানে স্বয়ং আল্লাহপাক তার প্রিয় হাবীবকে এ কথাগুলো বলেছেন। কেননা বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন ইয়াতীমদের সরদার। জন্মের পূর্বেই তার পিতা আব্দু- ল্লাহ ইন্তেকাল করেন। ইয়াতীমদের প্রতি কঠোর না হওয়ার শিক্ষাদানের প্রতি গুরুত্বারোপ করার জন্য আল্লাহ তায়ালা অত্র আয়াত অবতীর্ণ করেন।
ইয়াতিম ও অসহায়দের পুনর্বাসন ও আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আমাদের দেশেও সরকারী ও বেসরকারিভাবে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। তাই প্রত্যেক সম্পদশালী ব্যক্তির উচিৎ তাদের যাকাত, ফেত্রা, মান্নত ও সাধারণ দানের মাধ্যমে ইয়াতীমদের সাবলম্বী করে গড়ে তোলা। যাকাত না দেওয়ার পরিণাম সম্পর্কে হাদীসে এসেছে-
مَنْ أَتَاهُ اللهُ مَالاً ، فَلَمْ يُؤَدِ زَكَاتَهُ مِثْلَ لَهُ مَالُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ شَجَاعًا أَقْرَعَ لَهُ زَبِيْبَتَانِ يُطَوْقُه يَوْمَ الْقِيَامَةِ – ثُمَّ يَأْخُذُ بِلِهْزَمَتَيْهِ – يَعْنِي بِشَدِقَيْهِ – ثَمْ يَقُولُ أَنَا مَالُكَ أَنَا كَنْزُكَ
অর্থাৎ, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা ধন-সম্পদ দান করেছেন, অথচ সে তার যাকাত আদায় করেনি, উক্ত সম্পদকে কেয়ামতের দিন টাকমাথা সাপে পরিণত করা হবে। তার দু’চোখে কালো দু’টো দাগ থাকবে। অতঃপর ঐ সাপ গলার মালা হয়ে ব্যক্তির দু’চোয়াল আঁকড়ে ধরে বলবে, আমিই তোমার সম্পদ,
আমিই তোমার সংরক্ষিত ধন-সম্পদ (বুখারী)। সুতরাং ধনী ব্যক্তির উচিৎ সম্পদকে কুক্ষিগত না করে তার
যাকাত ও সাদাকাহ প্রাপকের নিকট সঠিকভাবে পৌঁছে দেওয়া। দারিদ্র্য, অসহায় ও অভিভাবকহীন যারা তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। আল্লাহ তায়ালা সকলকে তাওফিক দান করুন। আমীন
তামীরুল মিল্লাত ইয়াতিমখানার পক্ষ থেকে পাঠক মহলের প্রতি সবিনয় নিবেদন। এই প্রতিষ্ঠান ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে অদ্যবধি ইয়াতীম ও অসহায় শিশুদের সযত্নে লালন-পালন করে আসছে। অভিজ্ঞ পরিচালক ও শিক্ষক তারা পরিচালিত হওয়ার কারণে প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে এ পর্যন্ত অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থী তৈরি হয়েছে। যারা দেশের বিভিন্ন গুরত্বপূর্ণ সেক্টরে কর্মরত রয়েছে। এছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অত্র প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীবৃন্দ সুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছে।
বর্তমানে এ মকবুল প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ৫ম ও ৬ষ্ঠ তলার কাজ চলছে। এমতাবস্থায় আপনিও আপনার শুভাকাঙ্খী এ দ্বীনি প্রতিষ্ঠানে আপনাদের যাকাত, ফেখরা, সাধারণ দান অথবা এককালীন দান করে এ মহৎ কাজের অংশীদার হতে পারেন। অথবা আপনি দু’একজন ইয়াতীম শিশু এ প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করে বা দু’একজন ইয়াতীম শিশুর দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করে সাদাকায়ে জারিয়ার কাজে আঞ্জাম দিতে পারেন।
আপনি চাইলে খাদ্যদ্রব্য, শিক্ষা উপকরণ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী প্রদান করে ইয়াতিম শিশু প্রতিপালনের মতো মহৎ কাজে সামিল হয়ে দুনিয়া ও পরকালীন কল্যাণ লাভ করতে পারেন।