Table of Contents
সমৃদ্ধ ও স্বনির্ভর অর্থনীতি গঠনের অন্যতম হাতিয়ার হল যাকাত। ইসলাম ধনী শ্রেণীর ব্যক্তিদের উপর যাকাত ফরজ করেছে। যাকাত দরিদ্রদের প্রতি ধনীদের কোন করুণা করা বুঝায় না বরং এটি গরীবদের অধিকার এবং ধনীদের তা প্রদান করতেই হবে। ইসলামে যাকাত প্রদানের এই গুরুত্ব এবং সুষম বণ্টনের কারণে মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রে খোলাফায়ে রাশেদীন ও উমর ইবনে আব্দুল আযীযের শাসনামলে এমন একটি ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে সেখানে যাকাত গ্রহণ করার মত লোক খুঁজে পাওয়া যেত না।
যাকাত কাকে বলে
যাকাত ইসলামের অন্যতম মুজিযা ও তা যে আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে তার অন্যতম দলিল হল- কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কর্তৃক কোন দাবী উত্থাপন ছাড়াই ইসলাম দারিদ্র বিমোচনে সমাধান দিয়েছে। যাকাত ইসলামী দর্শনে এমন একটি হক যা ধনীদের কাছে জমানো দরিদ্রদের সম্পদ এবং ধনীদের তা দরিদ্রদের কাছে অবশ্যই পৌঁছে দিতে হবে। যাকাতের পরিমাণ ও হার নির্দিষ্ট। যাদের উপর যাকাত ফরজ হয়েছে এবং যারা যাকাত নেবে তারা উভয়ই এ বিষয়ে ধারণা রাখতে হবে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন- তাদের সম্পদে “গরীব ও বঞ্চিতদের জন্য হক রয়েছে।” (সূরা যারিয়াত: ১৯) পবিত্র কুরআন যাকাতকে দ্বীন ইসলামে প্রবেশের প্রতীক, মুসলিম ভ্রাতৃত্ব এবং মুসলিম সমাজের সথে সম্পৃক্ত হওয়ার যোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে অবহিত করেছে।” আল্লাহ বলেন- “তারা যদি তাওবা করে, সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয় তবে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই।” (সূরা তাওবা: ১১)
যাকাত এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহতে সালাতকে যাকাতের সাথে যুক্ত করে বর্ণনা করা হয়েছে। এমনকি পবিত্র কুরআনে ৮৬ বার সালাত ও যাকাতের কথা এসেছে এবং তার মধ্যে ৩৬ স্থানে সালাত ও যাকাতকে একসাথে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এ কারণেই যাকাত ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা সমৃদ্ধ অর্থনীতি গঠনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে।
যাকাত কাদের উপর ফরজ
১. মুসলিম হওয়া।
২. নেসাবের মালিক হওয়া।
৩. ঋণগ্রস্ত না হওয়া।
৪. নেসাব প্রকৃত প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া।
৫. নিসাব পরিমাণ সম্পদ ১ বছর স্থায়ী হওয়া।
৬. বেঁহুশ বা মস্তিষ্ক বিকৃত না হওয়া।
৭. বালেগ হওয়া।
কাদেরকে যাকাত দেয়া যাবে না
সাত ধরণের ব্যক্তিদের যাকাত দেয়া জায়েয নয়। দিলে যাকাত আদায় হবে না।
এরা হলো-
১ . বাবা-মা
২. দাদা-দাদী
৩. নানা-নানী
৪. সন্তান-সন্তুতি
৫. নাতী-নাতনী ইত্যাদি
৩. স্বামী-স্ত্রী
যাকাতের হিসাব
“ইয়েমেনের জনৈকা মহিলা নবী (সা.) এর খেদমতে হাজির হলো, তার সাথে তার মেয়ে ছিল যার হাতে সোনার দুটি মোটা কংকন ছিল। নবী (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি এর যাকাত দাও? সে বললো জ্বি না। নবী (সা.) বললেন: তুমি কি এটা পছন্দ করো যে, কেয়ামতের দিন ঐ অপরাধে তোমাকে আগুনের কংকন পরিয়ে দেয়া হবে। একথা শুনে মহিলাটি দুটি কংকন খুলে নবীর হাতে দিয়ে বললো, এগুলো আল্লাহ ও রাসূলের সন্তুষ্টির জন্য পেশ করছি। (নাসায়ী)
❖ সোনা রূপার সব রকমের অলংকারের যাকাত ওয়াজিব।
❖ সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ ও সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপায় ২.৫০% হারে যাকাত দিতে হবে। যাকাত হিসেবে সোনা-রূপা দেয়া বাধ্যতামূলক নয়। নগদ টাকা হিসেব করে দিলেও চলবে।
❖ কোন অলংকার, দলা অথবা কাপড়ে সোনা রূপা উভয়ই থাকলে যার যেটির পরিমাণ বেশি সেটির হিসেবে সমুদয় অলংকারের যাকাত দিতে হবে।
❖ নেসাব পূর্ণ করার পরেও যা’দ ব্যক্তির নিকট নেসাবের এক-পঞ্চমাংশ পরিমাণ স্বর্ণ অথবা রূপা থাকে তাহলে আইরিক্ত অংশের উপরও যাকাত ওয়াজিব হবে। এক পঞ্চমাংশের কম হলে যাকাত ওয়াজিব হবে না।
❖ সোনা বা রূপার অলংকারের সাথে যদি অন্য কোন ধাতু মিশ্রিত থাকে এবং এর পরিমাণ সোনা রূপার কম হয় তাহলে তা সোনা বা রূপা মনে করে যাকাত দিতে হবে। আর যদি তার মধ্যে সোনা রূপা কম হয় তাহলে শুধু সোনা রূপার যাকাত দিতে হবে।
❖ একজনের কাছে কিছু সোনা এবং কিছু রূপা আছে। তার মধ্যে যেটারই নেসাব পুরো হবে তার সাথে অন্যটার মূল্য হিসেব করে শতকরা আড়াইভাগ যাকাত দিতে হবে।
❖ যদি কারো নিকট সোনাও নেসাবের কম এবং রূপাও নেসাবের কম থাকে। তাহলে উভয়কে মিলিয়ে যেটির পরিমাণ বেশি সেটির হিসেবে যাকাত দিতে হবে।
❖ এমনি কিছু নগদ টাকা, কিছু স্বর্ণ অথবা কিছু রূপা এবং কিছু ব্যবসায়ী পণ্য আছে। তাহলে সব মিলিয়ে যদি সোনা অথবা রূপার নেসাব পুরো হয় তাহলে যাকাত দিতে হবে।
❖ অলংকারের মণিমুক্তায় যাকাত নেই। ওজনে সেগুলো বাদ দিয়ে বাকি সোনা রূপার শতকরা আড়াই ভাগ হিসেবে যাকাত দিতে হবে।
❖ পারিশ্রমিক হিসেবে কর্মচারীদের যাকাত দেয়া যাবে কি না?
কর্মচারীকে পারিশ্রমিক হিসেবে বা বেতন হিসেবে যাকাত দেয়া বৈধ নয়। তবে বায়তুল মালের পক্ষ থেকে যাকাত সংগ্রহ ও বণ্টনের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের বেতন যাকাতের টাকা থেকে দেয়া যেতে পারে। (রাসায়েল-মাসায়েল)
যাকাত দেওয়ার নিয়ম
* যে ব্যক্তি মালের যাকাত আদায় করে না। কিয়ামতের দিন তার মালকে তার জ ন্য একটি মাথায় টাকা পড়া (অতি বিষাক্ত) সাপ স্বরূপ করা হবে। যার চক্ষুর উপর দুইটি কালো দাগ থাকবে উহাকে তার গলার বেড়ী স্বরূপ করা হবে উহা আপন মুখের দুই দিক দ্বারা তাকে দংশন করতে থাকবে (অথবা উহা তার মুখের দিকে দংশন করতে থাকবে) এবং বলবে আমি তোমার মাল আমি তোমার সংরক্ষিত অর্থ – (বুখারী মিশকাত-১৫৫ পৃঃ)
* যাকাত সন্তুষ্ট চিত্তে আদায় করবে (মুসলিম) মিশকাত-১৫৬ পৃঃ)
❖ যাকাত আদায় করার সুন্নাত তরীকা
* বছর পূর্ণ হওয়র পর অতি তাড়াতাড়ি যাকাত আদায় করা।
* যাকাত আল্লাহর ওয়াস্তে আদায় করার নিয়ত করা।
* আপন জন ও এমন ব্যক্তি, যারা যাকাত গ্রহণ করতে লজ্জা বোধ করে, তাদেরকে যাকাত দেয়ার সময় যাকাতের টাকা বলবেনা।
* নেছাব পরিমাণ টাকা একজনকে না দেয়া।
* একজনকে এত পরিমাণ করে দিবে, যার দ্বারা ঐদিন অন্য কারো কাছে মুখাপেক্ষী না হতে হয়।
* ইলমে দ্বীন শিক্ষাকারী ছাত্রদেরকে দেওয়া সর্বোত্তম। অতঃপর নিজের আত্মীয় স্বজন থেকে যারা যাকাত পাওয়ার যোগ্য তাদেরকে দিবে, অতঃপর বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীকে দিবে। তারপর বাকীদেরকে দিবে।
যাকাত আদায় না করার পরিণাম
যে সোনা রূপার যাকাত আদায় করেনা-কেয়ামতের দিন সেগুলোকে পাত বানিয়ে আগুনে গরম করে তার পাঁজর কপাল এবং পিঠে দাগ দেয়া হবে। যে উটের যাকাত আদায় করে না কেয়ামতের দিন তাকে এক ধুধু ময়দানে উপুড় করে ফেলা হবে। আর তার সে সব উট যার একটি বাচ্চাও সে সেইদিন হারাবে না; বরং সবগুলোকে সে পাবে। তাকে তারা ক্ষুর দ্বারা মাড়াইতে থাকবে এবং মুখ দ্বারা কামড়াইতে থাকবে এভাবে যখনই উহাদের শেষ দল অতিক্রম করবে পুনঃ প্রথম দল আসি পৌছবে। এরূপ করা হবে (অর্থাৎ তারাও ক্ষুর দ্বারা মাড়াতে থাকবে এবং মুখ দ্বারা কামড়াইতে থাকবে) সেইদিন যার পরিমান হবে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান।
প্রত্যেক গরুছাগলের অধিকারী যে উহার পক্ষ হতে উহার হক যাকাত আদায় করবে না, কেয়ামতের দিন তাকে এক ধুধু মাঠে উপুড় করে ফেলা হবে; আর তার সে সকল গরুছাগল তাকে শিং মারতে থাকবে এবং ক্ষুরের দ্বারা মাড়াতে থাকবে। অথচ সেদিন তার কোন একটি গরু বা ছাগলই শিং বাঁকা শিং হীন বা শিং ভাঙ্গা হবে না এবং একটি মাত্র গরু ছাগলকেও সে হারাবে না। যখনই উহার প্রথম দল অতিক্রম করবে। শেষ দল আসি পৌঁচবে। এই রূপ করা হবে সেই দিনে, যেই দিনের পরিমান হবে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান (মুসলিম মিশকাত ১৫৫ পৃঃ)